চাঁদপুর সকাল

একটি মসজিদ নিয়ে নবীজি (সা.)–এর ব্যতিক্রমী নির্দেশ

১৬ দিন আগে
একটি মসজিদ নিয়ে নবীজি (সা.)–এর ব্যতিক্রমী নির্দেশ

ইসলামের ইতিহাসে ‘মসজিদে যিরার’–এর ঘটনা একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষণীয় অধ্যায়। মসজিদটি মদিনায় নির্মাণ করেছিল মোনাফেকরা (কপট বিশ্বাসীদের) মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্য ভাঙতে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালানোর উদ্দেশ্যে। মুহাম্মদ (সা.) তাই মসজিদ ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছিলেন।


ঘটনার পটভূমি

মদিনায় মুসলমানরা যখন ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত, তখন আবু আমির নামের খ্রিষ্টান সন্ন্যাসী ও তার মোনাফিক সহযোগীরা মসজিদে যিরার নির্মাণ করে। মসজিদটির অবস্থান ছিল তাকওয়ার ভিত্তিতে নির্মিত ইসলামের প্রথম মসজিদ ‘মসজিদে কোবা’র কাছাকাছি।


আবু আমির ছিলেন জাহেলি যুগে খাজরাজ গোত্রের একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি চেয়েছিলেন মসজিদটিকে মোনাফিকদের জন্য একটি গোপন ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে, যেখান থেকে মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা সহজ হবে।


তারা নবীজি (সা.)-কে এই মসজিদে নামাজ পড়ার আমন্ত্রণ জানান। দাবি করেন যে দুর্বল, অসুস্থ এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় আশ্রয় নেওয়ার জন্য এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। নবীজি (সা.) তখন তাবুক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন যে, তিনি ফিরে এসে এই মসজিদে নামাজ পড়বেন।


তাবুক থেকে ফেরার পর আল্লাহ তাআলা তাঁকে অহির মাধ্যমে মোনাফিকদের কপট উদ্দেশ্য জানিয়ে দেন। সুরা তাওবার ১০৭-১০৮ নম্বর আয়াতে এ ঘটনার বিবরণ এসেছে, ‘এবং তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে, কুফরের জন্য, মুমিনদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য এবং যারা আগে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তাদের একটি ঘাঁটি হিসেবে।


তারা শপথ করে বলবে, আমরা তো শুধু ভালো উদ্দেশ্যে এটি করেছি; কিন্তু আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে তারা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। আপনি কখনো এই মসজিদে নামাজে দাঁড়াবেন না। সেই মসজিদই (মসজিদে কুবা) তোমার জন্য উপযুক্ত, যা প্রথম দিন থেকে তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত।’


নবীজি এরপর মসজিদটি পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। মালিক ইবনে দুখশুম, মাআন ইবনে আদি বা তার ভাই আসিম ইবনে আদি দ্রুত তাঁর নির্দেশ পালন করেন। (আত-তাবারি, তারিখ আত-তাবারি, অনুবাদ: মুহাম্মদ আবদুল হাই, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ২০০৮, ৯/৬১-৬২)


আবু আমিরের ভূমিকা

ইসলাম গ্রহণের আগে আবু আমির খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। জাহেলি যুগে তিনি ছিলেন খাজরাজ গোত্রের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয়ী হলে তিনি মদিনা ত্যাগ করে মক্কার কুরাইশদের কাছে চলে যান এবং উহুদের যুদ্ধে তাদের সঙ্গে মিলিত হন।


উহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আবু আমির এই যুদ্ধে নবীজি (সা.)-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। তিনি এমনকি যুদ্ধের ময়দানে ফাঁদ তৈরি করেছিলেন, যার একটিতে নবীজি (সা.) পড়ে গিয়ে আহত হয়েছিলেন (ইবনে কাসির, তাফসির ইবনে কাসির, অনুবাদ: মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা: ২০১০, ৪/১২৩-১২৪)।


উহুদের পর তিনি রোমের সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে গিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে সহায়তা চান। তিনি মদিনার মোনাফিকদের সঙ্গে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তাদের মসজিদে যিরার নির্মাণ করতে নির্দেশ দেন , যাতে এটি তার পরিকল্পনার একটি ঘাঁটি হিসেবে কাজ করে (তাফসির আল-জালালাইন, অনুবাদ: ফাতিহা মুহাম্মদ সুলাইমান, দারুস সালাম, রিয়াদ: ২০০৭, পৃ. ২০১)।


ঘটনার শিক্ষা

আত-তাবারি বর্ণনা করেছেন যে, নবীজি (সা.) জু–আওয়ান নামক স্থানে অবস্থান করার সময় এই মসজিদ সম্পর্কে খবর পান এবং তৎক্ষণাৎ এর ধ্বংসের নির্দেশ দেন (আত-তাবারি, তারিখ আত-তাবারি, পৃ. ৬১)।


মসজিদে যিরার ঘটনা থেকে আমরা দুটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাই।


প্রথমত, এটি আমাদের শেখায় যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা অপব্যবহার করা যায় না। মসজিদ হলো আল্লাহর ইবাদত ও সম্প্রদায়ের ঐক্যের কেন্দ্র; কিন্তু মোনাফিকরা এটিকে ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল।


দ্বিতীয়ত, এ ঘটনা ইসলামের সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্ব দেয়। মোনাফিকদের কার্যকলাপ ছিল সমাজের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি এবং নবীজি (সা.)-এর সিদ্ধান্ত ছিল এই হুমকি প্রতিরোধের জন্য একটি সুদৃঢ় পদক্ষেপ।