টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন দেশের জন্য মাইলফলক : চাঁদপুর সিভিল সার্জন

সারা দেশে বিনামূল্যে টাইফয়েড টিকাদান কর্মসূচির অংশ হিসেবে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী ৮৮ হাজার ৪৫৭জন শিশুকে টিকাদানের লক্ষ্য নিয়ে রোববার থেকে উৎসবমূখর পরিবেশে শুরু হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিশু-কিশোরকে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া কার্যক্রম।
তবে ওই দিন রোববার উপজেলার ১নং ছেংগারচর ইউনিয়নসহ ৮টি ইউনিয়নে রুটিন ইপিআই টিকাদান কাজ থাকায় ওইসব ইউনিয়ন গুলোতে সোমবার (১৩ অক্টোম্বর) থেকে শুরু হয় ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী উৎসবমূখর পরিবেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিশু-কিশোরকে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইনের দ্বিতীয় দিন সোমবার চাঁদপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নুর আলম দীন মতলব উত্তর উপজেলার কয়েকটি এলাকার টাইফয়েড টিকাদান কেন্দ্র পরিদর্শন করেন।
এসময় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ মাহবুবুর রহমান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার এমওডিসি (রোগ নিয়ন্ত্রন) ডা.মোঃ মোবারক হোসেন, জেলা ইপিআই সুপারিন্টেন্ড (ভারপ্রাপ্ত) আজিজুল ইসলাম সবুজ, মতলব উত্তর উপজেলা মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (এমটি ইপিআই) ভাষান চন্দ্র কীর্ত্তনিয়া, স্বাস্থ্য পরিদর্শক সুভাষ চন্দ্র সরকার পরিদর্শনকালে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে দুপুরের দিকে ১নং ছেংগারচর ইউনিয়নের ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শন করেন, জেলা সিভিল সার্জন মহোদয়ের প্রতিনিধি এসআইএমও এবং জেলা ইপিআই সুপারিন্টেন্ড (ভারপ্রাপ্ত) আজিজুল ইসলাম সবুজ।
এসময় মতলব উত্তর উপজেলা মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট (এমটি ইপিআই) ভাষান চন্দ্র কীর্ত্তনিয়া, বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন মতলব উত্তর উপজেলা শাখার সভাপতি মোঃ কামাল হোসেন, প্রথম সারির সুপার ভাইজার রুপালী আক্তার, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক বিমল চন্দ্র দাস, ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) জুনায়েদ সিদ্দিকী, সহকারী শিক্ষক হুমায়ন কবির, রুহুল আমিন, রুমা আক্তার, উম্মে মাকতুম প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।
পরিদর্শনকালে চাঁদপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নুর আলম দীন বলেন, টাইফয়েডে এখনও আমাদের শিশুদের মৃত্যু হয়। এটা আমাদের লজ্জা। আমরা ডায়রিয়া, রাতকানার মতো রোগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছি। এবার টাইফয়েড প্রতিরোধেও সফল হব ইনশাআল্লাহ।’ তিনি বলেন, ‘টাইফয়েড এমন একটি রোগ, যা সচেতনতা ও টিকাদানের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যত বেশি শিশু টিকার আওতায় আসবে, ততই হাসপাতালের ওপর চাপ কমবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পথে এই কর্মসূচি একটি বড় পদক্ষেপ। সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নুর আলম দীন আরও বলেন, টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন শুধু একটি স্বাস্থ্য প্রকল্প নয় এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বিশেষ করে নিন্ম আয়ের পরিবারের শিশুদের জন্য এই উদ্যোগ একটি বড় পরিবর্তন আনবে।”
ডা. মোহাম্মদ নুর আলম দীন বলেন, ১৯৭৯ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) এর মধ্যদিয়ে শিশু, কিশোর ও প্রজন্মক্ষম নারীদের মধ্যে টিকা-প্রতিরোধযোগ্য রোগের কারণে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধকতা কমাতে কাজ করছে। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর প্রায় ৪২ লাখ শিশুকে বিভিন্ন প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের টিকা দেওয়া হয়, যার ফলে প্রায় এক লাখ শিশুর মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছ।’ সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ নুর আলম দীন বলেন, টাইফয়েড জ্বর বাংলাদেশের সবচেয়ে মারাত্মক টিকা-প্রতিরোধযোগ্য রোগগুলোর মধ্যে একটি, যা সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট।
টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।’ তিনি জানান, টাইফয়েড সাধারণত দূষিত পানি, খাবার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মাধ্যমে ছড়ায় এবং ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
তিনি বলেন, ‘২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৮ হাজার জন টাইফয়েডে মারা গেছেন, যার মধ্যে প্রায় ৬ হাজার বা ৬৮ শতাংশই ১৫ বছরের নিচের শিশু।’ ডা. মোহাম্মদ নুর আলম দীন আরো বলেন, ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড এখন বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের জন্য এক বড় উদ্বেগের বিষয়, কারণ অনেক সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারাচ্ছে। তাই টাইফয়েড টিকা গ্রহণের মাধ্যমে সংক্রমণের হার এবং অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের হার উভয়ই হ্রাস করা সম্ভব।
সিভিল সার্জন বলেন, টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (টিসিভি) একটি নিরাপদ ও কার্যকর টিকা, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও) দ্বারা পরীক্ষিত ও অনুমোদিত। এতে প্রোটিন ও শর্করা উভয় উপাদান রয়েছে, যা দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। তিনি বলেন, সরকার শুধু পরীক্ষিত ও নিরাপদ টিকা ব্যবহার করে কোনো পরীক্ষামূলক টিকা নয়। ডা. মোহাম্মদ নুর আলম দীন বলেন, পাকিস্থান ও নেপালের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যে সফলভাবে এই টিকা কার্যক্রম চালু করেছে। এই টিকা শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এবং ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েডের ঝুঁকি কমায়। টিকা নেওয়ার পর হালকা জ্বর, ব্যথা বা ক্লান্তি দেখা দিতে পারে, যা স্বাভাবিকভাবে সেরে যায়। আরো স্পষ্ট করে
তিনি বলেন, এই টিকায় ইসলামী শরীয়তে নিষিদ্ধ কোনো উপাদান নেই, বরং এটি সৌদি আরবের হালাল সেন্টার কর্তৃক হালাল সনদপ্রাপ্ত। তিনি বলেন, ইপিআই টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ পোলিও নির্মূল, হেপাটাইটিস-বি, হাম ও রুবেলা নিয়ন্ত্রণ এবং মাতৃ ও নবজাতক ধনুষ্টঙ্কার নির্মূলে সফল হয়েছে। একইভাবে টাইফয়েডও টিকাদানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করা সম্ভব। টাইফয়েড একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ।
সরকার জনগণের দোরগোড়ায় টিকা পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ ক্যাম্পেইনে অংশ নিয়ে তাদের সন্তানদের টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করতে অভিভাবকদের প্রতি আহবান জানান। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মতলব উত্তর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে ৪৩০টি কেন্দ্রে ৮৮হাজার ৪৫৭জন শিশুকে এবং কমিউনিটি পর্যায়ে ৩৬০টি কেন্দ্রে ২৮হাজার ১৯৩ জন শিশুকে শিশুকে এই টিকা প্রদান করা হবে।
৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী সকল শিশুকে টাইফয়েড প্রতিরোধী টিকার আওতায় আনা হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সরকারি স্বাস্থ্যসেবা সফল ও বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। উল্লেখ্য রোববার (১২ অক্টোম্বর) সকাল ১০টার দিকে উপজেলার গজরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদা কুলসুম মনি এ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধন করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানাগেছে, উপজেলায় মোট ৮৮হাজার ৪৫৭জন শিশুকে একডোজ করে টাইফয়েড টিকা প্রদান করা হবে। এদের মধ্যে স্কুল পর্যায়ে ৬০ হাজার ২শত ৬৪জন এবং কমিউনিটি পর্যায়ে ২৮হাজার ১৯৩ জন শিশুকে এই টিকা প্রদান করা হবে।




