চাঁদপুর সকাল

জুলাই গণঅভ্যুত্থান বর্ষপূর্তি : শহীদ স্মরণে জাতীয় ঐক্য, বিচার দাবিতে জোরালো জনমত

১৯ দিন আগে
জুলাই গণঅভ্যুত্থান বর্ষপূর্তি : শহীদ স্মরণে জাতীয় ঐক্য, বিচার দাবিতে জোরালো জনমত

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান, যা ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে পরিচিত, দেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটায়। আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নৃশংস দমননীতির ফলে সরকারি গেজেট অনুযায়ী ৮৩৪ জন শহীদ হন, যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্য উপ-কমিটি দাবি করেছে মৃতের সংখ্যা ১,৫৮১। এছাড়া, ১১,৩০৬ জন আহত এবং আনুমানিক ১১,০০০-এর বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই শহীদদের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশে চলছে নানা কর্মসূচি, যা ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলবে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম আকরাম, রিয়া গোপ, মো. রোমান, আরমান মোল্লা, হৃদয় চন্দ্র তরুয়া, ফারহান ফাইয়াজ, তানভীর, শান্ত, সাইমন এবং ছয় বছরের শিশু জাবির। তাদের আত্মত্যাগের স্মরণে দেশজুড়ে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জে ২১ জন শহীদের নামে ‘জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ গত ১৪ জুলাই উদ্বোধন করা হয়েছে, যেখানে রিয়া গোপ, মো. রোমান এবং আরমান মোল্লার নাম খোদাই করা হয়েছে। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ও মুরাদপুরে আটজন শহীদের স্মরণে স্ট্রিট মেমোরি স্ট্যাম্প নির্মাণ শুরু হয়েছে। ঢাকার মিরপুরে শহীদ ফারহান রোড এবং জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে শহীদ ফারহান ফাইয়াজ খেলার মাঠ নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া, শাহবাগে শহীদ আবু সাঈদের নামে একটি সড়ক এবং রংপুরে শহীদ মুগ্ধের নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামকরণ করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #JulyMassacre এবং #RememberingOurHeroes হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে শহীদদের স্মরণে প্রচারাভিযান চলছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শহীদদের স্মরণে এবং তাদের পরিবারের কল্যাণে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। গত ১৫ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদের স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ১৬ জুলাইকে ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই দিনে সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শহীদদের আত্মার শান্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। ড. ইউনূস বলেন, “জুলাই শহীদরা একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত এই সুযোগকে কাজে লাগাতে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”

সরকারি উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে শহীদ পরিবার ও আহতদের জন্য আর্থিক সহায়তা। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ৬২৮টি শহীদ পরিবার এবং ১,৬০১ জন আহতের মধ্যে ৪৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। গুরুতর আহতদের জন্য এককালীন ৫ লাখ টাকা (২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ লাখ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩ লাখ) এবং মাসিক ২০,০০০ টাকা ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন করা হয়েছে, এবং ৪০০-এর বেশি দৃষ্টিশক্তিহীন শিক্ষার্থীর জন্য বিশেষ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি চলছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদফতর’ এবং ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত এই ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সারজিস আলম, যিনি ২০২৫ সালের ২২ জানুয়ারি পদত্যাগ করেন। বর্তমানে মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

১৫ জানুয়ারি ২০২৫-এ ৮৩৪ জন শহীদের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে, যাতে তাদের নাম, পিতার নাম, বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানিয়েছেন, দেশের ৬৪টি জেলায় এবং ৮৬৪টি স্থানে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। গণভবনকে ‘জুলাই বিপ্লব স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদদের নামে শিক্ষাবৃত্তি চালু করা হয়েছে, এবং বাংলা একাডেমিতে জুলাই বিষয়ক বইমেলা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র সংগঠনের সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য কিছু কর্মসূচি:

১ জুলাই ২০২৫: জুলাই স্মৃতি উদযাপনের সূচনা। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দোয়া ও প্রার্থনা, জুলাই ক্যালেন্ডার বিতরণ, এবং হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে গণ-সাক্ষর কর্মসূচি শুরু হয়েছে।

৫ জুলাই ২০২৫: জাতীয় জাদুঘরে ‘শ্রাবণ বিদ্রোহ’ চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো প্রদর্শিত হয়েছে, যা দেশব্যাপী এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে প্রদর্শিত হচ্ছে।

১৪ জুলাই ২০২৫: নারায়ণগঞ্জে জুলাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন সম্পন্ন হয়েছে।

১৫ জুলাই ২০২৫: বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪’ প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে।

১৬ জুলাই ২০২৫: ‘জুলাই শহীদ দিবস’ পালিত হয়েছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং শহীদ মুগ্ধ ও আবু সাঈদের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। ‘বাংলা এডিশন’ নামে একটি গণমাধ্যম উদ্বোধন করা হয়।

১৮ জুলাই ২০২৫: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী গানের সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে।

২০ জুলাই ২০২৫: সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্র সংগঠনের সমাবেশ ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়েছে।

৫ আগস্ট ২০২৫: ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ পালনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষিত হয়েছে। গণভবনে বিশেষ সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।

শহীদ পরিবারগুলোর অভিযোগ, হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী অনেকে এখনও বিচারের আওতায় আসেনি। ১৪ আগস্ট ২০২৪-এ একজন শহীদ ছাত্রের পিতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনা ও নয়জন সহযোগীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। ১২ জানুয়ারি ২০২৫-এ চাঁকৈরপুল গণহত্যার ঘটনায় জড়িত কনস্টেবল সুজন হোসেন গ্রেপ্তার হন। তবে, শহীদ পরিবার ও আন্দোলনকারীরা বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার দাবি জানিয়েছেন।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন, প্রথম আলো।