চাঁদপুর সকালের ধারাবাহিক প্রতিবেদন : নির্বাচনের হাওয়া : পর্ব-২ চাঁদপুর-২ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচারণায় তৎপরতা

চাঁদপুর-২ আসন ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এই আসন থেকে জয়ী হয়েছেন। তবে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন এবং ২০২৫ সালের ১০ মে আওয়ামী লীগের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে এই আসনের রাজনৈতিক আবহে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। প্রায় পাঁচ লাখের বেশি ভোটার নিয়ে গঠিত এই আসনে গণতন্ত্রের চর্চা, বৈষম্য নিরসন, কৃষি উন্নয়ন, যুবকদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রভৃতি বিষয় ভোটারদের মূল চাহিদার তালিকায় রয়েছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ড. জালাল উদ্দিন ও জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ড. তানভীর হুদা এই আসনের অন্যতম দুই সম্ভাব্য প্রার্থী। দু'জনই মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয় এবং স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাঁরা ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়াতে বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং এলাকাবাসীর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক ও আলোচনা করছেন এবং গ্রামীণ ও শহুরে ভোটারদের কাছে উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিচ্ছেন।
অন্যদিকে বিভিন্ন সমাজকর্মী, ব্যবসায়ী ও যুব সমাজের সঙ্গে দুই নেতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যুবসমাজের কর্মসংস্থান ও শিক্ষার উন্নয়নও তাঁদের প্রচারণায় বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। স্থানীয় নেতারা বলছেন, বিএনপি'র এই দুই সম্ভাব্য প্রার্থীদের তরুণ ভোটারদের মাঝে জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
বিএনপির অন্যান্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ব্যারিস্টার ওয়াদুর রহমান টিপু, অধ্যাপক ডা. শামীম, ডা. মাহবুবুর রহমান শামীম, সাবেক চেয়ারম্যান এম এ শুক্কুর এবং ড. আনিসুল আউয়াল। তাঁরা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দলের ঐক্য ও মনোনয়ন পাওয়ার জন্য কাজ করছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বিএনপির এই প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দলটির অভ্যন্তরীণ ঐক্যের জন্য এক ধরনের চাপ তৈরি করতে পারে।
জামায়াতে ইসলামী দল থেকে মনোনীত প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবদুল মোবিন। ২০২৫ সালের জুনে জামায়াতের রাজনৈতিক নিবন্ধন পুনর্বহালের পর তারা স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ডা. মোবিন তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর জোর দিয়ে মতলব এলাকার ধর্মপ্রাণ ভোটারদের কাছে তাঁর অবস্থান সুসংহত করার চেষ্টা করছেন। সাম্প্রতিক গণসংযোগ ও রাজনৈতিক সভায় জামায়াতের শতাধিক নতুন নেতাকর্মী যোগদান করেছেন, যা তাঁদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ডা. মোবিন সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে ভোটারদের কাছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে মাওলানা মানছুর আহমেদ এবং সানোয়ার হোসেন মসজিদ ও ধর্মীয় সমাবেশে অংশ নিয়ে ধর্মীয় ভোটারদের সমর্থন লাভের চেষ্টা করছেন। তাদের প্রচারণার মূল বিষয় সামাজিক ন্যায়বিচার, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও গ্রামীণ উন্নয়ন। চাঁদপুর জেলা গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মোবাশ্বের আহমেদ (রাব্বি) এবং যুগ্ম সদস্য সচিব বিএম গোলাপ হোসেন তরুণ ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মাঠ পর্যায়ে সক্রিয় রয়েছেন। তারা ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের ধারাবাহিকতা এবং সংস্কারের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরছেন।
চাঁদপুর-২ আসনের ভোটার তালিকা হালনাগাদ এবং নির্বাচন কমিশনের চলমান সংস্কার কার্যক্রম ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থার সংকট দেখা দিয়েছিল। বর্তমান প্রক্রিয়াগত সংস্কার ও ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার ফলে তরুণ ভোটারদের মধ্যে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ার সম্ভাবনা বেশি।
এ পরিস্থিতিতে, চাঁদপুর-২ আসনে ২০২৬ সালের নির্বাচন বহুদলীয় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জমে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম, গণঅধিকার পরিষদ এবং ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা ভোটার সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে প্রচারণায় ব্যস্ত। ভোটারদের প্রত্যাশা, প্রার্থীদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, দলীয় ঐক্য এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা মিলিয়ে এই আসনের নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারিত হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বর্তমানে চাঁদপুর-২ আসনের নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক লড়াই নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যেখানে ভোটাররা তাদের ভবিষ্যৎ ও উন্নয়নের পথে প্রভাব ফেলতে চাচ্ছেন। তাই নির্বাচনী পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি, ভোটারদের মনোভাব ও প্রার্থীদের প্রচারণার ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ গুরুত্ব বহন করবে।



